শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫

প্রাণঘাতী অনশন, ইসলামী দৃষ্টিকোণ

প্রকাশিত: বুধবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৫

মানুষ নিজের প্রাণের মালিক নিজে নয়। প্রত্যেক প্রাণের মালিক মহান রাব্বুল আলামিন। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন। তিনি সব মানুষের জানের নিরাপত্তা দিয়েছেন।

তাই মানুষ নিজেকে নিজে কখনো হত্যা করতে পারবে না। বর্তমান বিশ্বে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে না খেয়ে আমরণ অনশনের প্রথা চালু আছে। উপমহাদেশে সাধারণত এ ধরনের আন্দোলনের সূচনা হলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। ইসলাম এ পদ্ধতির আন্দোলন সমর্থন করে কি না—এ ব্যাপারে আমরা কিঞ্চিৎ আলোকপাত করব।

আত্মহত্যার শাস্তি

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে ফেলো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)

আত্মহত্যাকারী নিজেকে যে উপায়ে হত্যা করবে, তাকে সেভাবে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামে লাফ দিতে থাকবে স্থায়ীভাবে।

আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে স্থায়ীভাবে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবে, জাহান্নামে সেই ছুরি তার হাতে থাকবে। তা দিয়ে সে তার পেটে আঘাত করবে, তাতে সে স্থায়ীভাবে থাকবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৭৮)
আত্মহত্যাকারী কি স্থায়ী জাহান্নামি?

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হলো, যারা ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে যাবে, তারা স্থায়ী জাহান্নামি হবে না। যে হাদিসে আত্মহত্যাকারীর জন্য স্থায়ী জাহান্নামের কথা রয়েছে, তার ব্যাখ্যা হলো, তা ওই লোকের জন্য, যে তাকে হালাল মনে করেছে।

তখন তো সে কাফির হয়ে যাবে। তাই আত্মহত্যাকারীকে যত দিন ইচ্ছা আল্লাহ শাস্তি দিয়ে পরে ঈমানের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আলমিনহাজ, নববি ২/১১৮)
আমরণ অনশনে নিহত ব্যক্তি আত্মহত্যাকারী

ইমাম আবু বকর রাজি (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকল, ফলে মরে গেল, সে আত্মহত্যাকারী। যার কাছে খাবার থাকা সত্ত্বেও না খেয়ে মারা গেল, সে মহা পাপ করল। (আহকামুল কোরআন : ১/১৭৭)

ইমাম সারাখসি (রহ.) লিখেন, নিজেকে হত্যা করা যেমন মহা পাপ, তেমনি নিজের হত্যার জন্য সহযোগিতা করাও পাপ। (শরহুস সিয়ারিল কাবির : ৪/১৪৯৮)

‘মুহিতে বুরহানি’ কিতাবে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকল, ফলে মরে গেল, তখন তার জন্য জাহান্নামে প্রবেশ ওয়াজিব হয়ে যাবে। কেননা সে নিজেকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করল। এটি ওই ব্যক্তির মতো, যে ছুরিকাঘাতে নিজেকে হত্যা করেছে। (আলমুহিতুল বুরহানি : ৫/৩৫৭)

প্রখ্যাত তাবেয়ি ইমাম মাসরুক (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি মৃত জন্তুর গোশত ছাড়া কোনো হালাল বস্তু খাবারের জন্য না পাবে, এমতাবস্থায় সে ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে, তার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ মৃত জন্তুর গোশত খেয়ে হলেও প্রাণ বাঁচানো ওয়াজিব। এমতাবস্থায় না খেয়ে মারা গেলে সে গুনাহগার হবে। (আলফাতাওয়াল কোবরা, ইবনে তাইমিয়া ১/৩৮৯)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লিখেছেন, চার মাজহাবের গ্রহণযোগ্য মত অনুসারে ক্ষুধায় মৃতপ্রায় লোকের ওপর মৃত জন্তুর গোশত খেয়ে প্রাণ বাঁচানো ওয়াজিব। (আলফাতাওয়াল কোবরা, ৫/৫৪৭)

অনশন ধর্মঘট করা কি বৈধ?

উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা স্পষ্ট হলো, যেকোনো কারণে না খেয়ে মারা যাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। অবৈধ দাবি আদায়ের জন্য তো নয়ই, এমনকি বৈধ ও ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্যও আমরণ খাবার ত্যাগ করে প্রাণঘাতী অনশনের পন্থা অবলম্বন করার অনুমতি নেই।

তবে শুধু বৈধ আদায়ের লক্ষ্যে জানের ক্ষতি বা অঙ্গহানি না হওয়ার শর্তে অনশন ধর্মঘটের অনুমতি রয়েছে। প্রাণহানি বা শারীরিক অস্বাভাবিক ক্ষতির উপক্রম হলে অনশন ভেঙে খাবার গ্রহণ করতে হবে, নতুবা খাবার না খেয়ে মারা গেলে আত্মহত্যার শামিল হবে, যার শাস্তি হলো জাহান্নাম। (কিফায়াতুল মুফতি ৯/৩০৫, ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া ২/৩৫৮)

তাই পরকালের কঠিন শাস্তিতে বিশ্বাসী কোনো মুসলমান এ পথ বেছে নিতে পারে না। চাই দুনিয়ায় সে যত বড়ই মসিবত বা জুলুমের সম্মুখীন হোক। কেননা এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর সামান্য লাভের জন্য যে আখিরাতের মহাবিপদ নিজের ওপর অবধারিত করে নিল, তার চেয়ে নির্বোধ আর কে আছে?

লেখক : মুফতি মাহমুদ হাসান, ফতোয়া গবেষক ও মুহাদ্দিস

আরো পড়ুন