শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, জুন ১৭, ২০২৫
মাত্র দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার শিকার খুলনা মহানগরী। মঙ্গলবার (১৭ জুন) সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত টানা বর্ষণে শহরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরীর হাজার হাজার বাসিন্দা। জলমগ্ন রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি প্রবেশ করায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি আবারও প্রশ্ন তুলেছে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত বছরগুলোতে ব্যয় হওয়া শত শত কোটি টাকার কার্যকারিতা নিয়ে।
খুলনা, যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার সমস্যায় জর্জরিত থাকে। রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটিতে অপর্যাপ্ত ও পুরানো ড্রেনেজ ব্যবস্থা, নদীর পলিজমা, অবৈধ দখল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিবৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজকের আকস্মিক জলাবদ্ধতা নগরীর রয়েল মোড়, জোড়াগেট, মিস্ত্রিপাড়া, লবণচরা, খানজাহান আলী রোড, ময়লাপোতা, খালিশপুর, বয়রা এবং নতুন বাজার এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। বহু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং বহু মানুষকে হাটু পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাটে পানি প্রবেশ করায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় দিনের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার ব্যয়, তবুও কেন এই দুরবস্থা?
খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত এক দশকে খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) এবং সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প হলো:
ড্রেনেজ উন্নয়ন প্রকল্প (২০১০-২০১৫): প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অধীনে প্রধান ড্রেন পুনর্গঠন, নতুন ড্রেন নির্মাণ ও পাম্পিং স্টেশন স্থাপনের কাজ করা হয়। তবে, স্থানীয়দের অভিযোগ, এই প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর সুফল মেলেনি।
পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (২০১৫-২০২০): এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে ৩০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে শহরের কিছু এলাকায় নতুন ড্রেন নির্মাণ ও পুরোনো ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দখলের কারণে এই উদ্যোগও প্রত্যাশিত ফল দিতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন (২০১৮-২০২৩): নগর অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের একটি বড় অংশ জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, খাল খনন ও পাম্পিং স্টেশন স্থাপনে ব্যয় হয়। যদিও এই প্রকল্পে কিছু অগ্রগতি দেখা যায়, তবে তা সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতিতে যথেষ্ট ছিল না।
জাইকার প্রকল্প (২০২০-২০২৪): জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির অর্থায়নে ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন খাল খনন ও ড্রেনেজ সিস্টেমের আধুনিকীকরণের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের কাজ এখনো চলমান, তবে আজকের জলাবদ্ধতা আবারও এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
খাল পুনঃখনন ও পাম্পিং স্টেশন: স্থানীয় উদ্যোগে এবং কেসিসি’র অর্থায়নে গত কয়েক বছরে খাল পুনঃখনন ও পাম্পিং স্টেশন স্থাপনে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু অবৈধ দখল এবং পলি জমার কারণে এসব উদ্যোগের সুফল সীমিত।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ৮২৩ কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়, যার মধ্যে ৫২৩ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা ছিল এবং যা জুন ২০২৫ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা, তার পরেও শহরের এই দুরবস্থা প্রমাণ করে যে, পরিকল্পনার অভাব, বাস্তবায়নে দুর্বলতা এবং তদারকির ঘাটতি ছিল প্রকট।
অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী ও খালের পলি অপসারণে নিয়মিত উদ্যোগের অভাব, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবই আজকের এই পরিস্থিতির মূল কারণ।
অন্যদিকে, জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত নগরবাসী তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, প্রতি বছর বর্ষায় একই ভোগান্তি পোহাতে হলেও সিটি কর্পোরেশন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাদের দাবি, নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার ও খাল পুনঃখনন করা হোক, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হোক এবং আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত পাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা হোক। পাশাপাশি, জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় হওয়া অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছেন তারা।
বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ করণীয়
আজকের জলাবদ্ধতা খুলনা শহরের নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পূর্বের প্রকল্পগুলোর অপর্যাপ্ততাকে আবারও প্রকটভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। জরুরি ভিত্তিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হলেও, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা অপরিহার্য।
প্রয়োজন:
পুরোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ।
নিয়মিতভাবে নদী ও খালের পলি অপসারণ এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনা করে নতুন ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিকল্পনা করা।
জলাবদ্ধতা নিরসনে বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
খুলনার এই জলাবদ্ধতা শুধু নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে না, এটি শহরের অর্থনীতি ও ভাবমূর্তির জন্যও একটি বড় হুমকি। এমতাবস্থায়, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমেই এই সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব। অন্যথায়, প্রতি বছর বর্ষা এলেই খুলনা মহানগরীকে একই দুর্ভোগের শিকার হতে হবে।
খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে অতীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও, আজকের দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই শহরের দুই-তৃতীয়াংশ তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, ব্যয়িত অর্থের কার্যকারিতা ছিল সীমিত।
অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ: ২০১০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যার মধ্যে ৮২৩ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ৫২৩ কোটি টাকা জুন ২০২৫ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।
কার্যকারিতা: ১৭ জুন ২০২৫ তারিখে দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই ব্যয়ের সীমিত সাফল্যের প্রমাণ।
সমস্যার কারণ: অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ, অবৈধ দখল, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই ব্যর্থতার পেছনে দায়ী।
নগরবাসীর প্রতিক্রিয়া: নগরবাসী কার্যকর ও টেকসই সমাধানের দাবিতে সোচ্চার এবং অতীতে ব্যয় হওয়া অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দাবি করছেন।
লেখক : বিএইচ সজল, সাংবাদিক